নারায়ণগঞ্জের কন্ঠ: রাত পোহালেই খুলে দেয়া হচ্ছে বহুল প্রত্যাশিত তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু। সাবেক সংসদ সদস্য মরহুম নাসিম ওসমানের নামে সেতুটির নামকরণ করেছে সরকার।
আগামীকাল সোমবার (১০ অক্টোবর) সেতুটি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পরপর যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে সেতুটি। বহুল কাঙ্ক্ষিত তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু চালু হলে খুলে যাবে সম্ভাবনার দুয়ার- এমনটি মনে করেন নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জের ব্যবসায়ীরা।
বিশেষ করে গার্মেন্টসসহ অন্যান্য শিল্পপন্য খুব সহজে চট্রগ্রাম-সিলেটসহ বিভিন্ন জেলায় দ্রুত পৌঁছে যাবে। এছাড়া শিল্পনগরী নারায়ণগঞ্জে কমে যাবে ভয়াবহ যানজট। পাশাপাশি শীতলক্ষ্যা নদী পাড়ি দিতে গিয়ে ট্রলার ও নৌকা দুর্ঘটনা কমে যাবে।সূত্র জানায়, সেতুটি ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়ক (জাতীয় মহাসড়ক-১), ঢাকা-সিলেট রোড (জাতীয় মহাসড়ক-২), ঢাকা-ময়মনসিংহ রোড ইত্যাদি থেকে
খুলনা, যশোর, বেনাপোল, মংলা, বরিশাল এবং অন্যান্য স্থানে যাতায়াতের জন্য মদনগঞ্জ-সৈয়দপুর-মুক্তারপুর, মুন্সীগঞ্জ-টঙ্গীবাড়ী-লৌহজং ও মাওয়া হয়ে মোগরাপাড়া, মদনপুর, কাঁচপুর ও ডেমরাকে সংযুক্ত করবে। সূত্র জানায়, সেতুটি চালু হলে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের সাথেও যোগাযোগ সহজ হবে। তখন দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলের যানবাহনগুলোকে নারায়ণগঞ্জ শহরে না ঢুকে মদনপুর হয়ে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া দিয়ে পদ্মা সেতু হয়ে যেতে পারবে।
একইভাবে পদ্মা সেতু হয়ে আসা যানবাহনগুলো তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু পার হয়ে মদনপুর দিয়ে দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলে যেতে পারবে। প্রত্যাশিত ছয় লেনের তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু নারায়ণগঞ্জ শহরকে বন্দর উপজেলার সাথে সংযুক্ত করার মাধ্যমে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে এবং পদ্মা সেতু হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলো ও চট্টগ্রামের মধ্যে যোগাযোগ সহজ করবে। সেতুটির প্রকল্প পরিচালক শোয়েব আহমেদ জানান, ১.২৯ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুটি চালু হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের মধ্যে চলাচলকারী
যানবাহনগুলো নারায়ণগঞ্জ শহরকে বাইপাস করতে পারবে এবং যানজট এড়াতে ও সময় বাঁচাতে সক্ষম হবে। তিনি বলেন, সেতুটি উদ্বোধনের পর দেশের অর্থনীতি উল্লেখযোগ্যভাবে চাঙ্গা হবে কারণ এটি দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে যানবাহনের যাতায়াতে সময় কমাবে। পদ্মা সেতুর সাথে সড়কগুলো পুনঃসংযোগ দিলে দেশ এ সেতু থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা পাবে। তিনি জানান, শীতলক্ষ্যা সেতু চালু হলে পঞ্চবটি বিসিক শিল্প এলাকা, পঞ্চবটি মোড়, চাষাড়া মোড়, সাইনবোর্ড, নারায়ণগঞ্জের চট্টগ্রাম সড়ক বা ঢাকার পোস্তগোলা ও শনির আখড়া রুটে যানবাহনকে তীব্র যানজটের সম্মুখীন হতে হবে না।
যানবাহনগুলো রাজধানীর পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জ শহরকে বাইপাস করতে পারবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাছাড়া রাজধানী ও নারায়ণগঞ্জ শহরের ওপর যানবাহনের চাপও কমবে। নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক (ডিসি) মঞ্জুরুল হাফিজ বলেন, ১০ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের সদর বন্দরবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর নির্মিত নাসিম ওসমান সেতু উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে সেতুটি উদ্বোধন করবেন। সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোস্তাইন বিল্লাহ জানান, ইতোমধ্যে তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু বা নাসিম ওসমান সেতুর নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়েছে। এটি শুধু বন্দর ও নারায়ণগঞ্জকেই নয়, পদ্মা সেতুর সাথে চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও সিলেট বিভাগকে সংযুক্ত করবে। আমাদের মহাপরিকল্পনা রয়েছে। আমাদের বিশ্বাস অনেক সুন্দরভাবে আমরা এই উদ্বোধন অনুষ্ঠানটি করতে পারব।
নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমান বলেন, নারায়ণগঞ্জে অনেক কাজ চলছে। কাজগুলো হয়ে গেলে ঢাকাকে বলবো- নারায়ণগঞ্জ এসে দেখে যান আমরা কারা। আমরা প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। নাসিম ওসমান সেতুসহ নারায়ণগঞ্জের আরো কিছু কাজ প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটি থেকে মুন্সিগঞ্জ পর্যন্ত ফ্লাইওভার হচ্ছে।
এগুলো হলে চিত্র পাল্টে যাবে। সেতুর নিকটবর্তী মদনগঞ্জের বাসিন্দা সাব্বির আহমেদ সেন্টু জানান, প্রতিদিন সকালে তাকে পায়ে হেঁটে গুদারাঘাটে আসতে হয় এবং তার কর্মস্থলে যেতে নৌকায় নদী পার হতে হয়। নৌকা প্রায়ই বড় জাহাজের সাথে সংঘর্ষে যাত্রীদের মৃত্যু ঘটায় কারণ সাম্প্রতিক সময়ে বাণিজ্যিক জাহাজের চলাচল অনেক বেড়েছে। এখন নৌকায় করে নদী পারাপার করা আমাদের জন্য ভীতিকর হয়ে পড়েছে। বর্ষাকালে ভয় বেড়ে যায়।
সেতুটি চালু হলে আমাদের চলাচল সহজ ও নির্ভয় হবে। বন্দর উপজেলার বাসিন্দা মাহফুজ আলম বলেন, সেতুটি স্থানীয় নয় বরং জাতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হবে। এখন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যানবাহন ঢাকার যাত্রাবাড়ী রুট ব্যবহার করে পোস্তগোলা ব্রিজ হয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলে যায় অথবা চাষাড়া ও সাইনবোর্ড রুট ব্যবহার করে গন্তব্যে পৌঁছায়।
সেতুটি পূর্বে বন্দর উপজেলার মদনগঞ্জ এবং পশ্চিমে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার সৈয়দপুরের সাথে যুক্ত হবে। এখন মোটরচালিত নৌকা নদীর দুই পাড়ের মানুষদের জন্য যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। জানা গেছে, প্রকল্পটি ২০১০ সালে একনেকে অনুমোদন পেলেও ২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি নির্মাণকাজ শুরু হয়। ওয়াকওয়েসহ সেতুটিতে ৩৮টি স্প্যান রয়েছে। এগুলোর মধ্যে পাঁচটি নদীতে এবং ৩৩টি পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে। হাঁটার পথসহ সেতুটির প্রস্থ ২২.১৫ মিটার।
এছাড়া ছয় লেনের টোল প্লাজা এবং দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ অ্যাপ্রোচ রোডও নির্মাণ করা হয়। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ১ হাজার ২৩৪ দশমিক ৫০ মিটার দৈর্ঘে ৬ লেন বিশিষ্ট তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুতে স্থানীয় ধীরগতির যানবাহন চলাচলের জন্য ভিন্ন লেন রাখা হয়েছে। এই সেতুটি উন্মুক্ত করার পর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাড়কের সাথে পদ্মা সেতুর দূরত্ব ৯ কিলোমিটার কমে যাবে। নারায়ণগঞ্জের মদনপুর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে এই সেতু মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুর থেকে শ্রীনগরের ছনবাড়ি পয়েন্টে যুক্ত হবে।
এর ফলে পদ্মা সেতুর সাথে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সহজ সড়ক নেটওয়ার্ক দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখবে। জানা গেছে, সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের এক প্রজ্ঞাপণে তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু টোল হার নির্ধারণ করা হয়। টোল হার অনুযায়ী, ট্রেলারে ৬২৫ টাকা, হেভি ট্রাকে ৫০০ টাকা, মাঝারি ট্রাকে ২৫০ টাকা, বড় বাস ২২৫ টাকা, মিনি ট্রাক ১৯০ টাকা, কৃষিকাজে ব্যবহৃত গাড়িতে ১৫০ টাকা, মিনিবাসে ১২৫ টাকা, মাইক্রোবাসে ১০০ টাকা, ফোর হুইল চালিত যানবাহনে ১০০ টাকা, ৩/৪ চাকার মোটরাইজড যানবাহনে ২৫ টাকা, মোটরসাইকেলে ১৫ টাকা, রিকশাভ্যান/রিকশা/সাইকেল/ঠেলাগাড়িতে পাঁচ টাকা টোল দিতে হবে।