কসবায় ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে পাঁচটি। ওই দুর্ঘটনার জের না কাটতেই গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় রংপুর এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা তদন্তে বিভাগীয় প্রধান কর্মকর্তা পর্যায়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। পশ্চিম রেলের সিওপিএস শহিদুল আলমকে প্রধান করে চার সদস্যের এ কমিটি করা হয়েছে।
কসবার দুর্ঘটনায় করা তদন্ত কমিটিগুলো ঘটনাস্থলে গিয়ে, সাক্ষ্য নিয়ে জেনেছে, তূর্ণা নিশীথার চালকের সংকেত অমান্যের ফলেই ওই দুর্ঘটনা ঘটে। চালক চারটি সংকেতের মধ্যে দুটি সংকেত মানেননি।
কিন্তু রেলওয়ে লোকো রানিং স্টাফ ও শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলীসহ চালকের পক্ষের নেতারা বলছেন, মন্দবাগ রেলস্টেশন এলাকায় মাটির স্তূপের ফলে রাতে সংকেত বাতি দেখা যায় না। আর দুর্ঘটনার রাতে রেলস্টেশন এলাকায় ঘন কুয়াশা ছিল।
জানা গেছে, ট্রেনচালক তাসের আলী ও তাঁর সহযোগীদের বাঁচাতে চালকদের একাধিক সংগঠনের কয়েকজন শ্রমিক নেতা আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতার কাছে ধরনা দিচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, এটি চালকদের বিরুদ্ধে যড়যন্ত্র।
রেলস্টেশনে ধাপে ধাপে চারটি সংকেত থাকে। আউটার, হোম, স্টার্টার ও অ্যাডভান্স স্টার্টার। গত সোমবার গভীর রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার মন্দবাগ রেলস্টেশনে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকামুখী তূর্ণা নিশীথার চালক তাসের আলী আউটার ও হোম এই দুটো সংকেত অমান্য করেন। এ ছাড়া চালক ভুল করলেও ট্রেনের গার্ড আবদুর রহমান ভ্যাকুয়াম চেপে ট্রেন থামাননি। পূর্ব রেলের প্রধান কার্যালয়ে বিভাগীয় তদন্ত কমিটির কাছে তূর্ণা নিশীথা ও উদয়ন এক্সপ্রেসের চালক ও গার্ড, মন্দবাগ ও কসবার স্টেশন মাস্টার এবং দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা সাক্ষ্য দিতে গিয়ে চালকের ভুল ও অন্য কর্মীদের ভুলের বিষয়টি তুলে ধরেন। গত বুধবার সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত তাঁদের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।
পূর্ব রেলের প্রধান পরিচালন তত্ত্বাবধায়ক নাজমুল ইসলাম এ তদন্ত কমিটির প্রধান। কমিটিতে অন্য সদস্যরা হলেন—পূর্ব রেলের প্রধান প্রকৌশলী মো. সুবক্তগীন, প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী মিজানুর রহমান ও প্রধান সংকেত কর্মকর্তা অসীম কুমার তালুকদার। তদন্ত কমিটির একাধিক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে নাম প্রকাশ না করে জানান, চালক, গার্ড ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। দুর্ঘটনার সময় ও আগে তাঁদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন তৈরি করা হচ্ছে।
তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা গেছে, ওই ট্রেন দুর্ঘটনার জন্য বেশির ভাগ সাক্ষী তূর্ণা নিশীথার চালক তাসের আলী ও সহকারী চালক অপু দে-কে দায়ী করেছেন। তাঁরা বলেছেন, তাসের আলীর ভুলেই মূলত দুর্ঘটনা ঘটেছে ও এত প্রাণহানি হয়েছে।
আর রেলের শ্রমিক সংগঠনের নেতারা তাসের আলীসহ তাঁর সহযোগীদের বাঁচাতে তদন্ত প্রভাবিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। তাঁরা ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নেতার নাম ব্যবহার করছেন বলেও জানা গেছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, তূর্ণা নিশীথার চালক একটি নয়, দুটি সংকেত অমান্য করেছেন। চারটি সংকেতই তূর্ণা নিশীথার জন্য বিপজ্জনক ছিল।
এ তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় রেল ভবনে জমা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আগেই সিরাজগঞ্জের উল্লাহপাড়ায় রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেন দুর্ঘটনায় পড়ে। এ কারণে রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা দুর্ঘটনাস্থলে ছুটি যান।
তদন্ত কমিটি তদন্ত শেষ করেছে বলে পূর্ব রেলের মহাব্যবস্থাপক নাসির উদ্দিন আহমেদ গতকাল কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন। তিনি জানান, বৃহস্পতিবার তদন্ত প্রতিবেদন জমা না হয়ে থাকলে আগামী রবিবার হবে। সব কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন জমা হওয়ার পর রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন তা গণমাধ্যমকে অবহিত করবেন।
এদিকে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কার্যালয় থেকে মন্দবাগ রেলস্টেশনে দুর্ঘটনার বিষয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়ে। দুর্ঘটনার সময় উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনের শেষ অংশের ঝ এবং ঞ নম্বর বগিতে আঘাত করা হয়। এতে তূর্ণা নিশীথা ট্রেনের কোনো বগি লাইনচ্যুত হয়নি। তবে ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উদয়ন ট্রেনের পেছনের দিকের সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়। ঝ বগিটি দুমড়ে-মুচড়ে যায় ও ঞ বগিটি বেঁকে যায়। দুর্ঘটনায় ১৬ জন যাত্রী নিহত ও প্রায় ১০০ জন আহত হন।
তূর্ণার চালকদের পাচ্ছে না জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি
ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি জানান, মন্দবাগে ট্রেন দুর্ঘটনায় জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটির কাছে গতকাল মো. রমজান মিয়া বলেন, ‘বিকট শব্দে ঘুম ভাঙলে ছুটে আসি। এসে দেখি ভয়াবহ অবস্থা। উদয়ন ট্রেনের যাত্রীরা চিৎকার করছেন। যে যেভাবে পারেন ট্রেনের ভেতর থেকে বের হয়ে আসছেন। অনেকে ভেতরে আটকা পড়েছেন।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিতু মরিয়মের নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্তদল দুপুরে মন্দবাগ গিয়ে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে দুর্ঘটনা সম্পর্কে ধারণা নেয়। এ ছাড়া ঘটনাস্থল ও এর আশপাশের এলাকা তারা ঘুরে দেখে। তবে তদন্তকাজ শেষ করতে পারেনি। মিতু মরিয়ম কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, বেশ কিছু কারণ তাঁরা খতিয়ে দেখছেন। তবে তূর্ণা নিশীথা এক্সপ্রেস ট্রেনের চালক ও সহকারী চালককে পাওয়া যাচ্ছে না বলে তদন্তকাজ এগোনো যাচ্ছে না। একই সঙ্গে আরেক তদন্তদলের সঙ্গে কথা বলতে চট্টগ্রামে অবস্থান করায় ওই সময়ে দায়িত্বে থাকা স্টেশন মাস্টারকেও পাওয়া যায়নি। তদন্তের ক্ষেত্রে তাঁদের প্রত্যেকের ভাষ্য জরুরি বলে তিনি জানান। এদিকে গতকাল দুপুর থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত কল করে তূর্ণা নিশীথার চালক তাছের উদ্দিন ও সহকারী চালক অপু দেব, মন্দবাগ রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার জাকের হোসেন চৌধুরীর মোবাইল ফোন বন্ধ পান এ প্রতিবেদক।
গত মঙ্গলবার গভীর রাতে মন্দবাগ রেলওয়ে স্টেশনে তূর্ণা নিশীথা ও উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনের সংঘর্ষে ১৬ যাত্রী নিহত ও শতাধিক যাত্রী আহত হয়।