নারায়ণগঞ্জের কন্ঠ: দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগের শাসনামলে দলটির নেতাকর্মীদের বেপরোয়া আচরণ এবং বেআইনি কর্মকাণ্ডে জীবন ছারখার হয়েছে বিপুলসংখ্যক মানুষের। শুধু বিরোধী মত বা দলের নেতাকর্মীরাই নন, আওয়ামী লীগের অত্যাচার ও নিপীড়ন থেকে রেহাই পাননি দেশের বিভিন্ন অঙ্গনের বিশিষ্টজন এবং তারকারাও। তবে সরকারের দমনমূলক মনোভাবের কারণে মুখ ফুটে সেসব কথা বলার সাহসটুকুও হয়নি ভুক্তভোগীদের। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সামনে আসছে এমন অজস্র কাহিনি। এর মধ্যেই একটি কাহিনি সংগীতশিল্পী শেখ ঊর্মী আরমানের, যাকে ইভা রহমান নামেই চেনে সবাই। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতার যোগসাজশে ইভা রহমানকে জিম্মি করে রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানে তার ১৮ কোটি টাকা মূল্যের দুটি ফ্ল্যাট দখলে নিয়েছে একটি চক্র। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও ফ্ল্যাট দুটি দখলমুক্ত করতে পারছেন না ইভা। বরং দীর্ঘদিন ধরে এই চক্রটির হয়রানির শিকার হয়ে নিজের বাড়িতেও স্বস্তিতে থাকার সুযোগ হচ্ছে না এই গায়িকার।
এই অবস্থার প্রতিকার পেতে গত ২৯ আগস্ট এ ঘটনায় ফকির গ্রুপের অন্যতম প্রতিষ্ঠান ফকির নিটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির আক্তারুজ্জামানকে প্রধান আসামি করে গুলশান থানায় মামলা করেছেন ইভা।
মামলায় নারায়ণগঞ্জ থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সাবেক দুই দাপুটে এমপি শামীম ওসমান, নজরুল ইসলাম বাবুসহ ছয়জনের নাম উল্লেখ এবং ৫০-৬০ জন অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। মামলার অভিযোগপত্রে ইভা দাবি করেছেন, আওয়ামী লীগের এমপিদের ইন্ধনে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে (বাবুর নির্বাচনী এলাকা) দীর্ঘদিন ধরে ভূমিদস্যুতা চালিয়ে আসছে ফকির গ্রুপ। স্থানীয় মানুষের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়ে অবৈধভাবে জমি দখল করে চলেছে প্রতিষ্ঠানটি।
সম্প্রতি গুলশানে এক সংবাদ সম্মেলনে ফকির আক্তারুজ্জামানকে স্বৈরাচারীর কালো হাত হিসেবে অভিহিত করে ইভা বলেন, এই ফকির আক্তারুজ্জামান ফ্যাসিস্ট সরকার শেখ হাসিনার অর্থ মজুতকারী, বিদেশে অর্থ পাচারকারী। এ ছাড়া বিভিন্ন মানুষের হক নষ্টকারী এবং জায়গা-জমি অবৈধভাবে দখলকারী।
নিজের ভোগান্তির দুঃসহ কাহিনি তুলে ধরে ইভা বলেন, তার গুলশানের বাড়ির দুটি ফ্ল্যাট জোর করে দখল করে রেখেছেন ফকির আক্তারুজ্জামান। তার দাপটের কারণে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বাড়ির কাজ শেষ করতে পারেনি। নিজের অর্থায়নে বাড়ির কাজ সম্পন্ন করেছেন জানিয়ে ইভা বলেন, ফকির আক্তারুজ্জামান ৪৬ লাখ টাকা করে দুটি ফ্ল্যাটের ৯২ লাখ টাকা দেন এবং কাজ শেষে বাকি টাকা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু কাজ শেষ হওয়ার পর টাকা না দিয়ে আমাকে এবং আমার সন্তানকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে জীবননাশের হুমকি দিয়ে জোরপূর্বকভাবে ফ্ল্যাট দুটির দখল করে নেন। আর কোনো টাকা দেবেন না বলেও জানিয়ে দেন। ফ্ল্যাট দখল করেই ক্ষান্ত হননি তিনি, এরপর পুরো বাড়ি দখলে নিতে বারবার চেষ্টা চালান।
ইভা জানান, ২০২১ সালে তিনি সোহেল আরমানকে বিয়ে করার কিছুদিন পর ফকির আক্তারুজ্জামান আবারও বাড়ি দখলের পাঁয়তারা শুরু করেন। এবার তার নেতৃত্বে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মফিজুল ইসলাম এবং তিতুমীর কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি রিপনসহ ৫০ থেকে ৬০ জন বাড়িতে হামলা চালিয়ে ইভা ও তার পরিবারকে উৎখাত করার চেষ্টা চালায়। ভাগী না ছাড়লে পুরো পরিবারকে হত্যা করার হুমকিও দেয় তারা।
তাতে কাজ না হওয়ায় এবার অন্য পথ ধরেন ফকির। এবার তার অপকর্মে যুক্ত হন প্রভাবশালী শামীম ওসমান ও নজরুল ইসলাম বাবু। সেই ঘটনা উল্লেখ করে ইভা বলেন, নজরুল ইসলাম বাবু এবং শামীম ওসমান আমাকে বারবার ফোন দিয়ে বাড়ি ছাড়তে হুমকি দিতে থাকেন। এমনকি বাড়িটি ফকির আক্তারুজ্জামানের নামে লিখে দেওয়ার জন্যও আমাকে বারবার চাপ দেন তারা। সাংবাদিক নামধারী আওয়ামী লীগের একজন নেতার কাছে সাহায্য চাইতে গিয়ে উল্টো বিপত্তিতে পড়েন ইভা। সেই সাংবাদিকও অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার পর নানাভাবে ইভাকে হুমকি দিতে থাকেন এবং দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলেন।
এরপর ফকির আক্তারুজ্জামান ইভা রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে নিজের বাড়িতে তিন মাস আত্মগোপনে ছিলেন বলে জানান ইভা। এ সময় তার ছেলেকে স্কুলেও পাঠাননি ভয়ে।
এ ঘটনায় বিচার চেয়ে ইভা রহমান বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন আমি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এবং জোরালোভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি এই ফকির আক্তারুজ্জামান ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী নজরুল ইসলাম বাবু, শামীম ওসমান প্রমুখের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
এসব ঘটনা নিয়ে কথা হয় ইভা রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, এখনো তার ফ্ল্যাট দুটি দখলমুক্ত করতে পারেননি। এ বিষয়ে গুলশান থানায় মামলা করেছেন তিনি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে মামলার প্রধান আসামি ফকির আক্তারুজ্জামানকে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। অন্য আসামিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গুলশান থানার এসআই রফিকুল ইসলাম বলেন, তদন্ত কার্যক্রম চলমান। প্রধান আসামি ফকির আক্তারুজ্জামানসহ সবাইকে খোঁজা হচ্ছে। এ বিষয়ে আমাদের টিম কাজ করছে। যেহেতু অধিকাংশ আসামিই পলাতক।
সূত্র কালবেলা অনলাইন