ডেস্ক রিপোর্ট:
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষিত হবে আজ বুধবার (১০ অক্টোবর)। দেশের ইতিহাসে এটিই প্রথম মামলা, যে মামলার আসামির তালিকায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দেশের সাবেক তিন আইজিপি ছাড়াও পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর একাধিক কর্মকর্তার নাম রয়েছে। একইসঙ্গে তারেক রহমানকে এ গ্রেনেড হামলার ষড়যন্ত্রের মূল ব্যক্তি বলে মনে করে রাষ্ট্রপক্ষ। তাই তারেক রহমানসহ এ মামলার সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করা হচ্ছে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে। অন্যদিকে আসামিপক্ষ মনে করছে, অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে তারেক রহমানসহ যাদের আসামি করা হয়েছে, সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। এসব আসামির বিরুদ্ধে আনা কোনও অভিযোগই রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে পারেনি বলেও মনে করেন আসামি পক্ষের আইনজীবীরা।
হাই প্রোপাইল এই মামলার রায়কে ঘিরে পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে স্থাপিত ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইবুনাল-১ এলাকায় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ মামলাকে ঘিরে পক্ষে-বিপক্ষে চলছে বক্তব্য পাল্টা বক্তব্য। গত ১৮ সেপ্টেম্বর যেদিন মামলার রায়ের দিন ধার্য করা হয়। মামলাটিকে রায়ের পর্যায়ে নিয়ে আসতে সহযোগিতার জন্য ওইদিন বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন সব পক্ষের প্রতি সন্তোষ প্রকাশ করেন। বিচারক আরও বলেন, ‘আসামিদের সহযোগিতা ছাড়া তো এ মামলা শেষ করাই যেতো না। আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে হয়তো আসামিদের অনেক আবেদন মঞ্জুর করতে পারিনি। তবে এ মামলার বিচারিক কার্যক্রম চলার সময়ে কখনও কাউকে অধিকার বঞ্চিত করিনি। বিচারিক কার্যক্রমে কোনও ফাঁক রাখিনি। তারপরও সিদ্ধান্ত একটা আমাকে দিতেই হবে।’
এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। আর এ হামলার ষড়যন্ত্রের মূল হোতা হচ্ছেন তারেক রহমান।’ বিচার কার্যক্রম চলার সময়ে আসামিদের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগই তারা প্রমাণ করতে পেরেছেন বলে জানান তিনি।
অন্যদিকে, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের আইনজীবী নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এ মামলায় তারেক রহমান ও বাবরকে আসামি করা হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। ৬১ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ হয়ে যাওয়ার পর অধিকতর তদন্তে মুফতি হান্নানের দ্বিতীয় একটি জবানবন্দির মাধ্যমে তাদের আসামি করা হয়েছে। যা আইনসম্মত হয়নি। এছাড়া তারেক রহমান ও বাবরসহ আসামিদের সাজা দেওয়া যায়, এমন কোনও তথ্য-প্রমান আমরা পাইনি। আমরা ন্যায় বিচারের অপেক্ষায় থাকলাম। আশা করি, সেই ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হবো না।’
বর্বরোচিত ও ভয়াবহ এ গ্রেনেড হামলার তদন্ত নিয়েও ঘটেছে নানা নাটকীয় ঘটনা। সাজানো হয়েছিল জজ মিয়ার নাটক। মামলা দায়েরের পর প্রথমে মতিঝিল থানা পুলিশ ও পরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ মামলাটির তদন্ত করে। গোয়েন্দা পুলিশ কিছুদিন মামলাটির তদন্ত চালানোর পর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি)-এর তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সিআইডির সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সাবেক এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান, সাবেক এএসপি আবদুর রশিদ পর্যায়ক্রমে তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত হয়ে মামলাটির তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তদন্ত শুরুর কয়েকদিন পরই নোয়াখালীর সেনবাগের জজ মিয়া নামের এক যুবককে গ্রেফতার করে গ্রেনেড হামলার রহস্য উদঘাটনের দাবি করেন সিআইডি’র কর্মকর্তারা। কিন্তু ২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেনের পটপরিবর্তনের পর ২১ আগস্ট হামলা মামলারও চিত্র পাল্টে যেতে থাকে। তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডির এএসপি ফজলুল কবিরকে। ২০০৮ সালের ৯ জুন হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনকে অভিযুক্ত করে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে সিএমএম আদালতে দু’টি অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন এএসপি ফজলুল কবির। ওই বছরই মামলা দু’টির কার্যক্রম দ্রুত বিচার ট্রাইবুনাল-১-এ স্থানাস্তর করা হয়। পুরনো ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডে পুরনো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে পিডব্লিউডির একটি পুরনো সরকারি ভবনকে অস্থায়ী আদালত ঘোষণা করা হয়। এ আদালতে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে ২৯/১১ (হত্যা), ও ৩০/১১ (বিস্ফোরক) নম্বর মামলা দু’টির বিচার কার্যক্রম চলে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় গেলে পুরোপুরি পাল্টে যায় এ মামলার তদন্তের ধারা। ৬১ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের পর ২০০৯ সালের ২৫ জুন আদালতের কাছে এ মামলার অধিকতর তদন্তের আবেদন জানান রাষ্ট্রপক্ষ। শুনানি শেষে ওই বছরের ৩ আগস্ট আদালত অধিকতর তদন্তের আবেদন মঞ্জুর করেন। অধিকতর তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আকন্দকে। দীর্ঘ তদন্তের পর তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ ও আবদুস সালাম পিন্টুসহ আরও ৩০ জনকে অভিযুক্ত করে ২০১১ সালের ২ জুলাই আদালতে সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করেন। অধিকতর তদন্তে গ্রেনেড হামলার সঙ্গে জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) পাশাপাশি হাওয়া ভবনের সংশ্লিষ্টতাও খুঁজে পান তিনি। মামলাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অভিযোগে সিআইডি’র প্রথম তিন তদন্ত কর্মকর্তাকেও অধিকতর তদন্তে অভিযুক্ত করেন আবদুল কাহার আকন্দ।
অভিযোগ গঠনের পর বিচারিক কার্যক্রম শুরুর পর ২২৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। এরপর আসামিদের জেরা করেন আসামি পক্ষের আইনজীবীরা। পরে রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষে ১১৯ কার্যদিবস যুক্তিতর্কের মাধ্যমে শুনানি করেন। এতে আসামিপক্ষ ৯০ কার্যদিবস এবং রাষ্ট্রপক্ষ ২৯ কার্যদিবস শুনানি করেছে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের সিনিয়র আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমান।
অধিকতর তদন্তের পর সম্পূরক চার্জশিটে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ৩০ জন আসামি যুক্ত হওয়ার পর এ মামলার আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২ জনে। এ মামলার বিচার কার্যক্রম চলার সময়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং সিলেটে সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা মামলায় হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আবদুল হান্নান ও তার সহযোগী শরীফ শাহেদুল আলম বিপুলের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় এ মামলার আসামিদের তালিকা থেকে তাদের বাদ দেওয়া হয়। এ মামলায় বর্তমানে আসামির সংখ্যা ৪৯। এসব আসামির মধ্যে পলাতক রয়েছেন ১৮ জন। বাকি ৩১ জন কারাগারে রয়েছেন।
উল্লেখ্য, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরদিন ২২ আগস্ট দণ্ডবিধির ১২০/বি, ৩২৪, ৩২৬, ৩০৭, ৩০২, ২০১, ১১৮, ১১৯, ২১২, ৩৩০, ২১৮, ১০৯ ও ৩৪ ধারায় মতিঝিল থানার এসআই শরীফ ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে একটি মামলা (নং-৯৭) দায়ের করেন। ২০০৮ সালের ৯ জুন হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনকে অভিযুক্ত করে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে সিএমএম আদালতে দু’টি অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন সিআইডির সিনিয়র এএসপি ফজলুল কবির। ওই বছরই মামলা দু’টির কার্যক্রম দ্রুত বিচার আদালত-১-এ স্থানান্তর করা হয়। এ আদালতে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনের ২৯/১১ (হত্যা) ও ৩০/১১ (বিস্ফোরক) মামলা দু’টির বিচার কার্যক্রম শুরু হয়।