নারায়ণগঞ্জের কন্ঠ:
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আজ। বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭১ সালের এই দিনে সংযোজিত হয়েছিল এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়ের প্রাক্কালে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী পরাজয় নিশ্চিত জেনে মেতে ওঠে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে। বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করতে নির্দয় হত্যাকাণ্ড চালায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যরা। রাতের অন্ধকারে লেখক-বুদ্ধিজীবী-শিক্ষাবিদ-চিকিৎসক-সাংবাদিক-প্রকৌশলীদের ধরে নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায়, সুপরিকল্পিতভাবে, পৈশাচিকপন্থায় সংঘটিত করা হয় এই হত্যাযজ্ঞ।
ইতিহাসের এই ঘৃণ্যতম ও বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের সূচনা হয় একাত্তরের ২৫ মার্চ, আর তা চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৪ ডিসেম্বর। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ধরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা এ দেশের মানুষের ওপর যে গণহত্যা ও নৃশংসতা চালিয়েছে, তার নজির ইতিহাসে খুব বেশি নেই। কিন্তু সেই নয় মাসের নৃশংসতা ছাপিয়ে গেছে যে মর্মান্তিক ঘটনা, তা হলো বিজয়ের প্রাক্কালে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করা।
স্বাধীনতাসংগ্রামের সূচনা থেকে শুরু করে চূড়ান্ত বিজয়ের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত আমরা এরকম অনেককে হারিয়েছি। মহান মুক্তিযুদ্ধে যেসব বুদ্ধিজীবী দেশ ও জাতির জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের মধ্যে আছেন- অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক জি সি দেব, ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, রাশেদুল হাসান, ড. আনোয়ার পাশা, শহীদুল্লাহ কায়সার, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, নিজামুদ্দিন আহমেদ, গিয়াসউদ্দিন আহমদ, ডা. আলিম চৌধুরী, ডা. ফজলে রাব্বী, সাহিত্যিক সাংবাদিক সেলিনা পারভীন ও আরো অনেকে।
১৪ ডিসেম্বরের এই হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম বর্বর ঘটনা, যা বিশ্বব্যাপী শান্তিকামী মানুষকে স্তম্ভিত করেছে। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের পর ঢাকার মিরপুর, রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধিজীবীদের লাশ ফেলে রেখে যায়। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পরপরই নিকট আত্মীয়রা মিরপুর ও রাজারবাগ বধ্যভূমিতে স্বজনের লাশ খুঁজে পায়। বর্বর পাক বাহিনী ও রাজাকাররা এ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের পৈশাচিকভাবে নির্যাতন করেছে। লাশের ক্ষত চিহ্নের কারণে অনেকেই তাঁদের প্রিয়জনের মৃতদেহ শনাক্ত করতে পারেননি।
দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাঙালির বিজয় অর্জনের ফলে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে এক স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। আমাদের জন্য তা এক মহত্তম অর্জন। কিন্তু বিজয়ের আনন্দ অনেকটাই বিষাদে পরিণত হয় লাখ লাখ সাধারণ মানুষ ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের কারণে। এসব বুদ্ধিজীবীসহ ৩০ লাখ শহীদ ও অসংখ্য নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি প্রিয় মাতৃভূমি।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আমরা আত্মত্যাগের মহিমায় ভাস্বর ওইসব মানুষকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি। যাঁরা ছিলেন দেশপ্রেম ও মননশীলতায় অগ্রণী এক প্রজন্ম। কিন্তু যাঁরা নিজেদের জ্ঞান-মনীষা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে জাতিকে পথ দেখিয়েছেন, আলোকিত করেছেন, তাঁদেরকে বছরের একটি দিন স্মরণ করলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। তাঁদের শিক্ষাকে অন্তরে ধারণ করতে হবে, নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে কেন তাঁরা জীবন দিয়েছেন। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতি সংরক্ষণের পাশাপাশি দেশকে তাঁদের অনুসৃত পথে চালিত করতে হবে।
যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত শীর্ষস্থানীয় অনেকের বিচারিক কার্যক্রম শেষ হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের দেওয়া দণ্ডাদেশ কার্যকরও হয়েছে। বাকি যুদ্ধাপরাধীদেরও পর্যায়ক্রমিকভাবে বিচার করা হবে বলে আমাদের প্রত্যাশা। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগ তখনই সার্থক হবে এবং তাদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হবে, যখন আমরা তাদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটাতে পারব।