একটি দেশের জাতীয় দলে বিভিন্নভাবেই ক্রিকেটার উঠে আসে। যেমন বয়সভিত্তিক লিগ, ক্রিকেট একাডেমি কিংবা ঘরোয়া ক্রিকেট আসর। তবে বাংলাদেশে ক্রিকেটার তুলে আনার ক্ষেত্রে ক্রিকেট বোর্ডের অবদান নেই। এই কাজটা করছেন জেলা পর্যায়ের কোচরা। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক কোচ পারভিন নাসিমা নাহার পুতুল এমনটাই মনে করেন। তার মতে, ক্রিকেট বোর্ড এই ক্রিকেটারদের আলাদাভাবে কোনো প্রশিক্ষণ দিয়ে দল বানাচ্ছে না। ক্রিকেটাররা উপজেলা-জেলা হয়ে, স্থানীয় কোচদের সাথে কোচিং করে প্রথম বিভাগ, দ্বিতীয় বিভাগে খেলার পর বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের বাছাই প্রক্রিয়া শুরু হয়।
বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দলের টেস্ট স্কোয়াডে নতুন একজন ক্রিকেটার সুযোগ পেয়েছেন, তার নাম সাইফ হাসান। ভারতের বিপক্ষে সদ্য সমাপ্ত টেস্ট সিরিজে সুযোগ পাওয়ার পরপরই আবাহনী ক্রিকেট ক্লাবের একাডেমিতে গিয়ে সতীর্থদের সাথে সেলিব্রেট করেন। এছাড়া সাদমান ইসলাম অনিক, নাজমুল হোসেন শান্তও বাংলাদেশের ক্রিকেট একাডেমির ছাত্র। বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলার সংস্কৃতি খুব বেশি সমৃদ্ধ বা পুরোনোও নয়। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর ওয়ানডে বা টেস্টে একটা ম্যাচ জয়ের জন্য লম্বা সময় অপেক্ষা করেছে। এরপর বাংলাদেশের নির্বাচকরা তুলনামূলক তরুণ ক্রিকেটারদের তৈরি করার দীর্ঘমেয়াদী একটা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল।
সম্প্রতি ভারতের মাটিতে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে বাংলাদেশের লজ্জাজনক পারফর্মেন্স এবং ইনিংস হারের মতো ঘটনায় সমালোচনার ঝড় উঠেছে। ক্রিকেটাররাও মিডিয়াকে এড়িয়ে চলছেন। প্রশ্ন উঠেছে ঘরোয়া ক্রিকেটের মান নিয়ে। ক্রীড়া সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রনি বলেন, ‘টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পরপর ঘরোয়া ক্রিকেটের অবস্থা ছিল খুব খারাপ, তখন নির্বাচকরা দুই ধাপে ভবিষ্যৎ ক্রিকেটার তৈরির কাজ করছিলেন। এক ধাপে এসেছিলেন আশরাফুল, নাফীস ইকবালরা। পরের ধাপে ছিলেন সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিমরা।’
সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিমরা ছিলেন বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র। তবে শুধু তরুণদের ওপর বিনিয়োগ করে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড খুব একটা সুফল পায়নি। আরিফুল ইসলাম রনি মনে করছেন, এই ব্যর্থতার পেছনে একটা বড় কারণ মানসিক বাধা। তার মতে, ‘ভালো প্রতিভাবান ক্রিকেটার পাওয়া কঠিন ছিল, স্কিলের সমস্যাও ছিল। এক্ষেত্রে চোখে পড়ে ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ব্যবধান অনেক বেশি। দল নির্বাচনে তার প্রতিফলন পড়ে।’
ভারতের বিপক্ষে দিবা-রাত্রির ইডেন টেস্ট মাথায় আঘাত পাওয়া লিটন দাসকে দিয়ে ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক ম্যাচের তারতম্য সম্পর্কে একটা ধারণা দেওয়া যেতে পারে। এই সুপার স্টাইলিস্ট ব্যাটসম্যান কিছুদিন আগেও ঘরোয়া ক্রিকেটে দুই শত রানের একটি ইনিংস খেলেন, কিন্তু জাতীয় দলে ঢোকার পরে তার ব্যাটে রান নেই। সম্প্রতি ভারতের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে তিন ম্যাচে লিটন দাস রান করেছেন ৪৫। দুই টেস্টের তিন ইনিংসে খেলেছেন ৩৫, ২১ এবং ২৪* রানের ইনিংস। ঠিক এই পার্থক্যের কারণে ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফর্ম করেও অনেকেই সুযোগ পান না।
ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে যেসব তরুণ ক্রিকেটার নিয়ে আসা হয়, তারা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সাথে খাপ খাওয়াতে অনেক সময় নিয়ে নেন। ঠিক এই সময়েই বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড বয়সভিত্তিক দলগুলো নিয়ে কাজ করা বাড়িয়ে দেয়। অনুর্ধ্ব-১৫, ১৭ ও ১৯ – তিনটি জাতীয় দল গঠন করে বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ড। এক্ষেত্রে অবশ্য আইসিসির নীতিমালা ও বাধ্যবাধকতাও ছিল। এই সময়টাতেই অনুর্ধ্ব-১৯ দল থেকে নিয়মিত ক্রিকেটার উঠে আসা শুরু করে। বাংলাদেশের বয়স-ভিত্তিক দলগুলো থেকে ক্রিকেটার তুলে আনার দায়িত্ব ছিল নাজমুল আবেদীন ফাহিমের কাঁধে। যিনি বিসিবি গেমস ডেভেলপমেন্টের ন্যাশনাল ম্যানেজার ছিলেন।
এই নাজমুল আবেদীন ফাহিমের অধীনেই দেশসেরা ওপেনার তামিম ইকবাল অনুর্ধ্ব-১৫ দলে খেলেছেন। কিন্তু তামিম ইকবাল, সাকিব আল হাসান কিংবা মুশফিকুর রহিম যেভাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসে মানিয়ে নিয়েছেন বা নিজেদের আরো এক ধাপ সামনে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন সেক্ষেত্রে বাকিরা অধিকাংশই ব্যর্থ হয়েছেন। সৌম্য সরকার, লিটন দাস, এনামুল হক বিজয় এর বড় উদাহরণ। দীর্ঘদিন বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দলে খেলেও ঠিক প্রত্যাশামতো পারফরম্যান্স দিতে ব্যর্থ হয়েছেন তারা।
পরবর্তীতে ঘরোয়া ক্রিকেটের ওপর জোর আরো বাড়ানো হয়। ২০১৬-১৭ সেশনে বাংলাদেশের বয়সভিত্তিক জাতীয় দলের ক্রিকেটের তিনটি স্তর ১৫, ১৭ ও ১৯ এর জন্য পরীক্ষা নেয়া হয়। সেই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন ৩০,০০০ ক্রিকেটার। সেখান থেকে ৮২ জন ক্রিকেটারকে নির্বাচন করে বয়স অনুযায়ী ভাগ করে দেয়া হয়। নাজমুল আবেদীন ফাহিম মনে করেন, এই ৩০ হাজার একটা সংখ্যা মাত্র, এদের মধ্যে ১০ শতাংশও যদি সিস্টেমে ঢুকে যায় সেটাও অনেক বড় ব্যাপার হবে বাংলাদেশের মতো দেশে।
‘বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও জানে যে বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেট মানসম্মত নয়, এজন্যই তারা ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো খেললেও সরাসরি তাকে দলে নেয়ার ক্ষেত্রে ভাবে। এমতাবস্থায় ধীরে ধীরে পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে। যেমন ঘরোয়া ক্রিকেটে যারা ভালো করছে তারা ‘এ’-দলে খেলছে। হাই পারফরম্যান্স টিম তৈরি হচ্ছে। বিগত তিন চার বছর ধরে ‘এ’-দল ও এইচপি দল নিয়মিত মাঠে নামছে। যেখানে ইমরুল কায়েস, সৌম্য সরকার, তাসকিন আহমেদের মতো ক্রিকেটাররা বিভিন্ন দেশে সফর করেছেন।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের গেম ডেভেলপমেন্টের কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘যত একাডেমি থাকবে আমাদের জন্য সেটা তত ভালো। আমরা সেখান থেকে তুলে আনি। অনুর্ধ্ব-১৪ বলেন অনুর্ধ্ব-১৮ হোক একাডেমি থেকেই তারা এই পর্যায়ে আসে। আমরা স্কুল ক্রিকেট ও বয়স-ভিত্তিক দুটো গ্রুপ করি। সেখানে জেলা পর্যায়ে আমাদের ৬৪জন কোচ আছেন। তারা জেলা থেকে বিভাগ, বিভাগ থেকে কেন্দ্রে আসে। এরপর আমরা দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের পথে এগিয়ে যাই। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের বন্ধু সংগঠন হিসেবে কাজ করে বিকেএসপি। বিকেএসপি থেকেই আমরা ক্রিকেটার পাই, আবার আমরা যে হান্টিং করি তারাই তো বিকেএসপিতে ভর্তি হয়। যা আমাদের জন্য ইতিবাচক।’